নিজেস্ব প্রতিনিধিঃ টানা তিন বছর বিপর্যয়ের পর এবার চামড়ার দাম কিছুটা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। পশু কোরবানি দেওয়ার পর থেকেই ফড়িয়ারা কাঁচা চামড়া সংগ্রহ শুরু করেছেন।
ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা গতবারের চেয়ে একটু বেশি দামে চামড়া কিনবেন। তবে ফড়িয়া বা মৌসুমী ব্যবসায়ীদের চামড়া কেনার সময় কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, গত তিন মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম একটু বাড়তি। এই মধ্যে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চামড়ার চাহিদা বাড়ছে। ফলে গতবারের চেয়ে এবার চামড়ার দাম বাড়তে পারে। তবে সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চামড়া কিনতে বারণ করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, মৌসুমী ব্যবসায়ীরা যদি লোকসান এড়াতে চান তাহলে চামড়া আড়তে অথবা ট্যানারিতে আজ রাত দশটা থেকে এগারটার মধ্যে পৌঁছাতে হবে। রাত ১১টার বেশি হলে লোকসানে পড়বেন তারা।
তিনি উল্লেখ করেন, মৌসুমী ব্যবসায়ীরা যেন সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে চামড়া না কেনেন, পাশাপাশি তারা যেন রাত ১১টার আগেই চামড়া বিক্রি করে দেন।
এদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতি বিবেচনা করে গতবারের চেয়ে একটু দাম বাড়িয়ে কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। লবণজাত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৪০-৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩-৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর ঢাকায় ৩৫-৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮-৩২ টাকা ছিল।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, দেশে করোনা প্রকোপ বাড়লেও আন্তর্জাতিক চামড়ার বাজার গতবারের চেয়ে এবার একটু ভালো মনে হচ্ছে। তবে সরকার যেহেতু গতবারের চেয়ে দাম বাড়িয়ে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেই দামেই মৌসুমী ব্যবসায়ীদের চামড়া কেনার পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে তথ্য বলছে, চার বছর পর সদ্য সমাপ্ত অর্থবছর প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে চামড়াজাত পণ্যের রফতানি। বাংলাদেশে করোনার প্রভাব থাকলেও এর প্রধান বাজার ইউরোপের দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এ কারণে রফতানি আদেশও বেড়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থবছর (২০২০-২১) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয়েছিল ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। ফলে বছরের ব্যবধানে রফতানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ।
তথ্য বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ১১৩ কোটি ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে ১১৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ আয় আরও বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে চামড়াশিল্প থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি আয়।
এরপর থেকেই ধস নামে এ খাতের রফতানিতে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও কমে ১০২ কোটি ডলারে নামে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে।
প্রসঙ্গত, করোনাকালের আগের বছর ২০১৯ সালে দেশে কোরবানি পশুর চামড়া নিয়ে এক ধরণের হযবরল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। দাম না পেয়ে ১০-১৫ শতাংশ গরুর চামড়া সড়কে ফেলে এবং মাটিতে পুঁতে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। আবার সময়মত লবণ না দেওয়া, বৃষ্টি ও গরমের কারণেও ২০ শতাংশ গরুর চামড়া নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নষ্ট হওয়া চামড়ার আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা। ওই বছর ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৫-৫০ টাকা। অথচ ঈদের দিন বিকেলে ঢাকায় ৩০০ থেকে ৮০০ টাকায় গরুর চামড়া বিক্রি হয়। আবার পরদিন পুরান ঢাকার পোস্তার চামড়ার আড়তে বিক্রি হয় ১৫০-২০০ টাকায়। ঢাকার বাইরের চিত্র ছিল আরও ভয়াবহ।
চামড়া নিয়ে নৈরাজ্যের পর ওই বছরের ২৮ আগস্ট সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, ‘চামড়া নিয়ে এবার আমার শিক্ষা হয়েছে। এবারের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে একটি পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছি। যে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহে বড় ধরনের কোনও সংকট তৈরি হবে না। কিন্তু ২০২০ সালের কোরবানির পশুর চামড়ার দামেও বিপর্যয় নামে। ঈদের দিন পুরান ঢাকার চামড়া আড়ত পোস্তায় গরুর চামড়া আকারভেদে ১৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছাগলের চামড়ার দাম ছিল ২ থেকে ১০ টাকা। বিনা পয়সায়ও ছাগলের চামড়া আড়তে রেখেও গেছেন কেউ কেউ। চট্টগ্রামে গরুর চামড়া আকারভেদে ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রি হয়। সব মিলিয়ে গত বছর অনেকটা পানির দরেই বিক্রি হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া।